বর্ষায় কুয়াকাটা ভ্রমণ!
প্রকাশিতঃ ১০:০৩ অপরাহ্ণ | আগস্ট ২২, ২০২০ । এই নিউজটি পড়া হয়েছেঃ ৬৪৭ বার

ওমর ফারুক সুমন, কুয়াকাটা থেকে ফিরেঃ শীত মৌসুমে সাধারণত সাগর বেশ শান্ত থাকে। তাই ঢেউয়ের আকারও দেখা যায় অনেক ছোট। আগে একবার কুয়াকাটা গিয়েছিলাম। তখন ছিল শীতকাল। তাই এবার বর্ষাকালে উত্তাল সমুদ্র দেখার ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের। অবশেষে তা বাস্তবে রূপ দিয়ে ফেলি। সাগরে তখন তিন নম্বর সতর্ক সংকেত চলছে। বিশাল বিশাল ঢেউ দেখার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম সময় আর হতে পারে না।দিনক্ষণ ঠিক করে ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চ সুন্দরবন-৬ যোগে রওনা হয়ে গেলাম কুয়াকাটার উদ্দেশে। আমার সাথে সাভার আশুলিয়ার আরেক সফরসঙ্গী সাংবাদিক আব্দুস সাত্তার। লঞ্চের মাঝেই রাতের ডিনার শেষ করে নিলাম। নদীর তাজা ইলিশ খেতে অনেক মজাই লাগলো। লঞ্চ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। আকাশ ভরা চাঁদ, রাতের নিস্তব্ধতা, স্নিগ্ধ বাতাস—সব মিলিয়ে এক মনোরম অনুভূতি। লঞ্চের সঙ্গে দুলতে দুলতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরও পাইনি। ঘুম ভাঙলো অনেক পর। সকাল সাড়ে ১০ টায় পৌছি পটুয়াখালীর কলাপাড়া লঞ্চ ঘাটে। লঞ্চ থেকে নামলাম! বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি। তাই কলাপাড়া একটি হোটেলে প্রবেশ করে নাস্তার কাজটা সেড়ে নিলাম। এরই মাঝে আমাদের সাথে যোগ হলো বরগুনার এক প্রিয়জন অনেক ভালোবাসার মানুষ সাংবাদিক মিরন আহমেদ, কলাপাড়ার স্থানীয় সাংবাদিক আরিফ ভাই, কলাপাড়া পৌর সভার এক কর্মকর্তা শাকিল আহমেদ ও বরগুনার আরেক ছোট ভাই মিরাজ আহমেদ।সকলে মিলে পায়রা বন্দর দেখার কাজটা শেষ করে লাঞ্চ করে নিলাম। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টিও থেমে থেমে হচ্ছে। স্থানীয় সুহৃদ সংবাদ কর্মীদের সাথে হোন্ডায় করে চললাম কুয়াকাটা সৈকতের দিকে। ততক্ষণে আকাশ পরিষ্কার। নাশতা করেই চলে গেলাম সাগরের পাড়ে। বিশাল একেকটা ঢেউ যেন আস্ত মানুষ উড়িয়ে নিয়ে যাবে! এত বড় ঢেউ দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। পয়সা খরচ করে কুয়াকাটা আসা সার্থক মনে হলো।
যারা বর্ষায় কুয়াকাটা যাননি তারা সমুদ্রের সত্যিকারের রূপ দেখেননি। এই সময়ে ঢেউয়ের আকার শীতকালের চেয়ে দ্বিগুণ হবেই। মাঝে মাঝে হাল্কা বৃষ্টিও হচ্ছে। আবার থামছে। আমরা হাটছি। ইতিমধ্যে স্থানীয় সংবাদ কর্মী সাইফুল ইসলাম জুলহাসসহ আরও দুইজন সংবাদকর্মী আমাদের সাথে যোগ হয়েছে। চা খেলাম সাগরের পাড়েই। সন্ধ্যা আসতেই স্থানীয় সুজনরা সকলে যার যার গন্তব্যে চলে গেলো। আমিসহ পাঁচজন রয়ে গেলাম। এবার সাগরের তাজা মাছের ফ্রাই খাবারের পালা। রুপচাঁদা, শাপলা আর টুনা মাছের ফ্রাই ভাজা শুরু। এমন সময় শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টি আর বৃষ্টি। সাথে বাতাস। আশ্রয় নিলাম পাশেই ভাঙ্গা টিনের ঘরে। বৃষ্টির দাপট কিছুটা কমলে ফ্রাই খাওয়া শুরু। কিছুক্ষন পর রাতের ডিনার ছেড়ে হোটেলে ঢুকি। পরদিন সমুদ্রে স্নান করবো এই হলো সিদ্ধান্ত। সকালের নাস্তা শেষ করে সবাই অবস্থান করি সাগরের পাড়ে। ভাবছি সাগরের এতো গর্জনে পানিতে নামবো কিনা। পাশে যারা ছিলো তারা ততক্ষনে সাগরের পানিতে দিয়েছে লাফ। তাদের সাহস দেখে নিজেও আমতা আমতা করে নেমে পড়ি। এরই মাঝে কলাপাড়া থানার রঞ্জু ফরাজী নামে এক পুলিশ ভাই আমাদের খোজ খবর নিচ্ছে। তিনি আমাদের সাথে সময় দিচ্ছে প্রথম দিন থেকেই। স্প্রিড বুটে সাগরের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো পুলিশ ভাই। স্প্রিড বুটে জোর করেই তুলে দিলো। ও মাই গড! সাগর কি উত্তাল। স্প্রিড বোট সাগরের ভিতরে প্রবেশ করলো। ঢেউয়ের তালে তালে ৫-৭ ফুট উচুতে লম্ফ দিচ্ছে বোট। বুকে পানি নেই। অনেক ভয় লাগছিলো। যাই হোক কোনমতে কিনারায় আসি। এরপর পানিতে নামি।
আমরা ঢেউয়ের তালে তালে পানিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। একেকটা ঢেউ এসে সবাইকে নাকানিচুবানি খাওয়ায় আর অমনি সবার হৈহুল্লোড়! মাঝে মধ্যে এত বড় ঢেউ এসেছিল যে, লাফিয়েও হার মানতে হলো। ঢেউয়ের তোপের মুখে বেশ কয়েকবার সমুদ্রের লবণাক্ত পানি গিলতে হয়েছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক জলকেলির পর বেলা পড়ে যাচ্ছে দেখে উঠে আসতে হলো। তবে মোটেও মন চাচ্ছিল না। হোটেলে ফিরে বিকালে বৌদ্ধ মন্দিরে ঘুরতে গেলাম। রাতে ফের সৈকতে গিয়ে দেখি সমুদ্র মহাশয় বড়ই ক্ষেপেছেন! দিনের চেয়ে রাতে অনেক বড় বড় ঢেউ। একেকটা ঢেউ তো অন্তত ফুট বিশেক হবেই। ভয়ানক গর্জন ঝেড়ে একের পর এক বিশাল ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে। সমুদ্রের যেন কোনও ক্লান্তি নেই, তার বিশ্রামেরও প্রয়োজন নেই। অনবরত গর্জন করেই চলছে আর মুখ থেকে আছড়ে ফেলছে সাদা ফণা।
বিচে সমুদ্রের কিনার ধরে হেঁটে এলাম সকলে। পুরো পথই কেটেছে দারুণ মুগ্ধতায়। উপভোগ করেছি সাগরের ভয়ানক রূপ। এরপর সাগরের টেংড়া মাছের বারবিকিউ খেয়ে আবারও পা রাখলাম বালুকাবেলায়। ততক্ষণে মাথার ওপর থেকে চাঁদমামা জোছনার স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে। জোয়ার আসায় সাগরের ঢেউ আরও বড় হয়েছে। আর সাগর থেকে মৃদু ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ওপর থেকে নামছে চাঁদের আলো, নিচে সাগরের ঢেউ, সামনে বইছে মৃদু হাওয়া। আর কী চাই!
এমন সময়ে একটা চেয়ার নিয়ে বসে গেলাম। তখন মনে হচ্ছিল, অন্য কোনও রাজ্যে হারিয়ে গেছি! সেই মুহূর্তটি ছিল চোখের জন্য প্রশান্তিদায়ক, মনের জন্য তৃপ্তিকর, কানের জন্য শ্রুতিমধুর। একেই বুঝি বলে সুখকর মুহূর্ত! ঢেউয়ের ফণায় চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে সাগরকে করে তুলেছিল আরও মোহনীয়। সাগরের এমন দারুণ সৌন্দর্য উপভোগ করেছিলাম আরও ঘণ্টাদেড়েক। এরপর ফিরে আসি হোটেলে। পরদিন সাগরের পাড়ে কিছু কেনাকাটা করে বিকেল চারটায় বরগুনার আমতলী লঞ্চ ঘাট থেকে বিদায় নিই। অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নিই আমতলী লঞ্চ ঘাট থেকে।কিছু স্মৃতি কিছু কথা তালতলী ঘাটে আবেগাপ্লুত করে। যাত্রা এখানেই শেষ হয়। রয়ে যায় কিছু স্মৃতি।