মৃত তরুণীর শরীরে লেখা ফোন নম্বর! সেই সূ্ত্রেই প্রকাশ্যে এল…
প্রকাশিতঃ ৮:২৮ অপরাহ্ণ | সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৮ । এই নিউজটি পড়া হয়েছেঃ ৬০৪ বার
অনলাইন ডেস্কঃ মৃত্যু নিশ্চিত। গাড়িতে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকতে থাকতেই বুঝতে পেরেছিলেন ১৯ বছরের জেহানা। তাই সবার অলক্ষ্যে নিজের শরীরে লিখে রেখেছিলেন দু’টি ফোন নম্বর। আর সেই ফোন নম্বরের সূত্র ধরেই তদন্তে জানা যায় নৃশংস এক হত্যার পেছনে থাকা জঘন্য সামাজিক ব্যাধির গল্প।
গত ৩১ অগস্ট সকালে বর্ধমান শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে নবগ্রামে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের পাশেধান খেতের মধ্যে এক তরুণীর দেহ দেখতে পানস্থানীয়েরা। পরনে গোলাপি সালোয়ার-কামিজ। মুখটা ভারী কোনও কিছু দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। যাতে শনাক্ত করা না যায়।
অজ্ঞাতপরিচয় লাশ হিসেবেই সেই তরুণীর দেহ চালান হয়ে যায় মর্গে। নিয়মমাফিক ময়নাতদন্তের সময়ে মর্গের ডোমের চোখে পড়ে, তরুণীর দেহে দু’টি ফোন নম্বর লেখা রয়েছে। সেই ফোন নম্বরের সূত্র ধরেই পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর থানার পুলিশ মুম্বইতে হদিশ পায় করণ সিংহ নামে এক যুবকের। জেলা পুলিশের দল মুম্বই পৌঁছয়। সেখানে করণকে তাঁরা ওই মৃত তরুণীর ছবি দেখাতেই জানা যায় ওই মৃতের নাম জেহানা খাতুন। বাড়ি বিহারের মুজফ্ফরপুরের ইলাদাদ গ্রামে। ওই একই গ্রামে করণেরওবাড়ি।
করণকে জিজ্ঞাসা করেই তদন্তকারীরা জানতে পারেন, জেহানার সঙ্গে তাঁর ‘ভালবাসা’র কথা। কিন্তু করণ অন্য ধর্মের হওয়ায় সেই সম্পর্ক মেনে নেয়নি জেহানার পরিবার। একবার করণের সঙ্গে বিয়ে করবে বলে পালিয়েও গিয়েছিল জেহানা। কিন্তু তারপর মেয়েকে ফিরিয়ে আনেন জেহানার বাবা মহম্মদ মুস্তাক। মেয়েকে বুঝিয়ে করণের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলেন। তবে, ওই সম্পর্ক থেকে মেয়েকে তিনি বার করতে পারেননি।
করণের সঙ্গে কথা বলেই তদন্তকারীরা সন্দেহ করেন, জেহানা খুনের সঙ্গে যোগ থাকতে পারে তাঁর বাড়ির লোকজনের। করণের কাছ থেকেই পুলিশ জানতে পারে জেহানার বাবা মুস্তাক এবং দাদা জাহিদ কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় থাকেন। কলকাতা শহরে তাঁরা গাড়ি চালান। অন্যদিকে, পুলিশের একটি দল জেহানার বিহারের বাড়ি পৌঁছয়। সেখানে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, কয়েকদিন আগেই জেহানাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছে তাঁর বাবা-দাদা।
সেই সূত্র ধরেই রবিবার রাতে কলকাতায় পার্ক সার্কাস এবং আনন্দপুর এলাকায় হানা দেয় পুলিশ। আটক করা হয় জেহানার বাবা এবং দাদাকে।জেরার মুখে মুস্তাক স্বীকার করেন যে নিজের মেয়েকে খুন করেছেন তিনি। কিন্তু কেন?
পুলিশকে জেহানার বাবা-দাদা জানিয়েছেন, অন্য ধর্মের ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁদের গ্রামের লোকজনও মেনে নেয়নি। গ্রামের মোড়লরা রীতিমতো একঘরে করে রেখেছিল তাঁদের। তারপর অনেক অনুরোধের পর গ্রামের মাতব্বররা নিদান দেন যে, ওই মেয়েকে গ্রামের বাইরে কোথাও থেকে বিয়ে দিয়ে আসতে হবেমুস্তাককে। তাকে গ্রামে রাখা যাবে না।
মঙ্গলবার বর্ধমান আদালতে হাজির করা হয় মুস্তাক এবং জাহিদকে। এ দিন আদালতে যাওয়ার পথে জাহিদ বলেন,“প্রথমে আমরা বিয়ে দেওয়ার জন্যই বোনকে কলকাতায় এনে রেখেছিলাম। কিন্তু করণকে কোনও ভাবেই বোন ছাড়তে রাজি ছিল না। তাই আমরাও আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।” জাহিদ জানিয়েছে, ওই রাতে বিহারেই ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কলকাতা ছাড়ে তিনজন।দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই মত পরিবর্তন করেন মুস্তাক। জাহিদ বলেন,“বাবা বার বার বলতে থাকেন, বোনের বিয়ে দিয়েও লাভ নেই। ও আবার পালিযে যাবে করণের কাছে। তখন আমি বাবাকে বলি, করণের সঙ্গেই তবে বিয়ে দিয়ে দাও।”
কিন্তু, তা মানতে পারেননি মুস্তাক। গাড়ি চালাচ্ছিলেন জাহিদ। পেছনের আসনে ছিলেন মুস্তাক এবং জেহানা। মুস্তাক আদালতের পথে খুব নিস্পৃহ-নির্বিকার মুখে বর্ণনা করেন, ঠিক কীভাবে খুন করেছেন মেয়েকে। প্রৌঢ় বলেন, “জেহানাকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই গাড়ির মধ্যে গলায় দড়ির ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করি। তারপর সেই দেহ টেনে নিয়ে যাই ধান খেতে। সেখানে পাথর দিয়ে মাথায় মুখে আঘাত করে বিকৃত করি মুখ, যাতে কেউ চিনতেও না পারে।”
পূর্ব বর্ধমান জেলার পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ধৃতদের আমরা জেরা করছি। এই খুনের পিছনে আরও কোনও কারণ আছে কি না, আমরা খতিয়ে দেখব।’’
খুনে ব্যবহৃত গাড়ি থেকে শুরু করে দড়ি সবই উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে যে ভাবে নির্বিকার মুখে মুস্তাক তাঁর এই খুনের বর্ননা দিয়েছেন তা তাজ্জব করে দিয়েছে তদন্তকারীদেরও। তারপরেও মুস্তাকের মনোভাবে স্পষ্ট, মেয়ের প্রাণের চেয়েও সামাজিক বিধি তাঁর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।