‘তারা শিশুগুলিকে চাপাতি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে আগুনে ছুড়ে মারে’
প্রকাশিতঃ ৮:৪৭ অপরাহ্ণ | জুলাই ০১, ২০১৮ । এই নিউজটি পড়া হয়েছেঃ ৪২৪ বার
সীমান্তবার্তা ডেস্ক :প্রথমে তারা আমাদের শিশুগুলিকে শূন্যে ছুড়ে মারে। পরে বড় ছোরা, চাপাতি দিয়ে তাদের কেটে কুচি কুচি করে এবং আগুনে ছুড়ে মারে।’
রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যে বিভৎস নিপীড়ন চালিয়েছে, রোহিঙ্গা নারী ফাতিমা বেগমের কণ্ঠে সেই তথ্য এভাবেই উঠে এসেছে।
ব্রিটেনের ডেইলি মিররের বিশেষ প্রতিনিধি টম পেরিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তারা একটি শিশুকে কেটে চার টুকরা করেছে। এর পর সেই টুকরাগুলো আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে দিয়েছে।
এই বিভৎসতা তার সামনেই ঘটেছে বলে জানান ফাতিমা। তিনি বলেন, আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি। বোবা হয়ে যাই। এই বর্বরতা স্বচক্ষে দেখার পরও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। বিশ্বাস করতে চাইনি।
কিন্তু আমি জানি, আমাদের গ্রামের বহু নারীর কাছ থেকে তাদের সন্তাদের এভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশ কিছু শিশুকে পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে দিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
ওই রোহিঙ্গা নারী বলেন, প্রথমে আমাদের বসতবাড়িতে আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। এর পর আমার স্বামীকে প্রথমে গুলি করে। পরে গলা কেটে তাকে হত্যা করেছে।
তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের সেই বিভৎসতার কথা বলে বোঝানো অসম্ভব।
ফাতিমা বলেন, অল্পবয়সী, সুন্দরী ও কুমারী ২০ নারীকে পলায়নরত অবস্থায় ধরে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
এর পর শিশু ও সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যার বিবরণ শোনা গেছে তার মুখ থেকে।
সাংবাদিক টম পেরি বলেন, কক্সবাজারের কুতুপালংয়ের একটি আশ্রয়শিবিরে আমি ফাতিমার সঙ্গে দেখা করি। প্রচণ্ড তপ্ত গরমের মধ্যে চালের জন্য অপেক্ষারত সারিতে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন।
মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর হাতে তার স্বামী নিহত হওয়ার পর সন্তানদের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা তাকেই করতে হচ্ছে। জাতিসংঘ, ব্রিটেন যাতে গণহত্যায় জড়িত জেনারেলদের শাস্তির ব্যবস্থা করে, সেই দাবিতে তিনি কথা বলতে চান।
ফাতিমার কোলে ১৪ মাস বয়সী শিশুকন্যা হাসিনা। তিনি বলেন, আমি প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছি। যখন খড়কুটায় নির্মিত বসতবাড়ি আগুন গিলে ফেলছিল, তখন পেছনে না তাকিয়ে সবকিছু ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসি।
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা বনের ভেতরে পালিয়ে ছিলাম। কিন্তু আমাদের আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। তাই আমার স্বামী খাবার আনতে বাড়ির দিকে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে হানাদাররা অপেক্ষা করছিল।
‘সেনারা প্রথমে আমার স্বামীকে গুলি করে। পরে চাপাতি দিয়ে তার গলাকেটে দুই ভাগ করে ফেলে। এভাবে ৩০ জনকে হত্যা করে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছে,’ বলেন ফাতিমা।
তিনি বলেন, এর পর আর পেছনে তাকানোর সাহস পাইনি। পাহাড়ের দিকে চার দিন একনাগারে দৌড়েছিলাম, কোনো ধরনের খাবার-পানি ছাড়াই।
সাংবাদিক টম পেরি লিখেছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে ভাগ করে দেয়া নাফ নদীর কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আশ্রয় শিবিরগুলোতে যাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তাদের সবাই অকল্পনীয় বিভৎসতা থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছেন।
তাদের বর্ণনার প্রতিটি শব্দ সেই নির্মমতারই সাক্ষ্য দিয়েছে।
তাতমাডো এভাবেই ভয়ঙ্করভাবে রাখাইনে জাতিগত নির্মূল অভিযান চালিয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে তাতমাডো বলা হয়।
চলতি শতাব্দীতে গণহত্যার সবচেয়ে ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডটি সারতে তারা সেখানে একাধারে গণহত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়ন চালিয়েছে।
নাফ নদীর তীরে টম পেরির সঙ্গে দেখা হয় চার রোহিঙ্গা পরিবারের। গত একদিন আগে ভেলায় চড়ে তারা নদীটি পার হয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
২৭ বছর বয়সী নাজিমার তিনটি সন্তান মাটির মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়েছিল। তাদের শরীরজুড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার ক্লান্তি ভর করছিল। একদিকে তারা যেমন ক্লান্ত ছিলেন, অন্যদিকে পানিশূন্যতায় ভুগছিলেন।
নাজিমা বলেন, ভেলায় ওঠার সময় লুকিয়ে থাকা সেনারা পিস্তল দিয়ে পেটালে তার স্বামী আসতে পারেনি। তিনি মিয়ানমারে রয়ে গেছেন।
কেউ পালিয়ে আসতে চেষ্টা করছে বলে স্নাইপাররা দেখতে পেলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানালেন নাজিমা।
সেখানে খাবারের অপেক্ষায় থাকা সারিতে কেবল নারীরাই ছিলেন। কয়েক হাজার পুরুষকে পাহাড়ের ওপাশে মিয়ানমারের বাহিনী হত্যা করেছে।
হত্যাকাণ্ডের স্থানে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাহায্য সংস্থাকে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছে।
টম পেরি বলেন, শিশুদের জন্য তৈরি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা ২০ বছর বয়সের আমিনার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তার কোলে ছিল আট মাস বয়সী সন্তান মোহাম্মদ ও ১৮ মাসের কন্যা মাহিয়া।
তাদের তাবুর আশ্রয় স্থানটি ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা সিএএফওডির সহায়তায় নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। আমিনার বক্তব্যও উল্লেখ করার মতো।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় তিনি আট মাসের গর্ভবতী ছিলেন। আমিনা কথা বলছিলেন অস্থিরভাবে। তিনি বলেন, তারা আমাদের সন্তানদের এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করেছে। বন্য জানোয়ারের মতো তাদের কেটে টুকরা টুকরা করেছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী আমার স্বামীকেও নির্যাতন করেছে। কিন্তু তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে বলে জানিয়ে নাজিমা বলেন, গর্ভাবস্থার কারণে আমি বেশি দৌড়াতে পারিনি।
নাজিমা বলেন, সবাই ভয়ে সন্ত্রস্ত ছিলেন। যার যার মতো করে পালাচ্ছিলেন। আমি যতটা সম্ভব চালিয়ে যাচ্ছিলাম। যখন আমি নদীর কাছে বনের ভেতর পৌঁছালাম। আমার পেটের ব্যথা ওঠে এবং আমি সন্তান জন্ম দেই। বনের ভেতরে একা একা আমি কাঁদছিলাম।
তিনি বলেন, আমাদের পাশের গ্রামের মেয়েরা আমার কান্না শুনতে পেয়ে সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তারাই সংযোজক নারী কেটে দেন।
‘আমি একনাগারে ১২দিন হেঁটেছি। আমি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলাম। পার্শ্ববর্তী মেয়েরা আমার সহায়তায় এগিয়ে আসেন এবং একটি ডিঙ্গিতে উঠতে আমাকে সাহায্য করেন।’
নাজিমা বলেন, সদ্য জন্ম নেয়া মোহাম্মদ নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে থাকে। তার ত্বকে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। সে জ্বরে ভুগছে।
তার জন্য বিস্ময়কর খবর হচ্ছে, বাংলাদেশে আসার পর কয়েক সপ্তাহ পরে মেয়ে মাহিয়ার সঙ্গে তার দেখা মিলেছে।
কক্সবাজারের আশ্রয়শিবির বিধবায় ভরে গেছে। তাদের চোখে মুখে সন্তান হারানোর শোক।
৩০ বছর বয়সী তিয়ারফুল নুর বেগম তার ১২ বছর বয়সী সন্তানকে গুলি করে হত্যার বিবরণ দেন। অন্য ছেলে মেয়েদের নিয়ে তিনি পালিয়ে আসতে পেরেছেন।
তিনি বলেন, যখন আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম, তখন তারা আমাদের ঘরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
শোকসন্তপ্ত এই মা বলেন, আমরা সব হারিয়েছি। তারা আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। এর পর এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। আমার সন্তান আমার সামনেই লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা দৌড় থামাতে পারেনি। সন্তানের লাশ ফেলে রেখেই পালিয়ে আসতে হয়েছে।
মিয়ামনারের স্টেট কাউন্সিলর নোবেলজয়ী অং সান সুচি এই গণহত্যার বিষয়টি এখনও স্বীকার করেননি। যদিও অক্সফোর্ড-শিক্ষিত সুচিকে ১৫ বছর ধরে গৃহবন্দী করে রেখেছিল দেশটির সেনাবাহিনী।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আন্তর্জাতিক বিচার বিষয়ক সহকারী পরিচালক পরম-প্রীত সিং বলেন, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশগুলোর উচিত হাত কচলানো বন্ধ করা এবং মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে হাজির করতে একটি প্রস্তাব উপস্থান করা।